১৯৯৯ বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে অপরাজিত ১১৩

সাঈদ আনোয়ার: অন্তত সেদিনের ‘বেস্ট’

উৎপল শুভ্র

২৭ এপ্রিল ২০২১

সাঈদ আনোয়ার: অন্তত সেদিনের ‘বেস্ট’

১৯৯৯ বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে সাঈদ আনোয়ার। ছবি: গেটি ইমেজেস

এক সময় ডেসমন্ড হেইন্সের সবচেয়ে বেশি ওয়ানডে সেঞ্চুরি রেকর্ড ভাঙার দৌড়ে তিনি ছিলেন সবার আগে। ১৯৯৮ সালে ঢাকায় ইন্ডিপেন্ডেন্স কাপ ফাইনালে তাঁর ১৫ নম্বর সেঞ্চুরি, হেইন্স তখন মাত্র দুই কদম দূরে। পরে ওয়ানডে সেঞ্চুরিকে ছেলেখেলা বানিয়ে ফেলা শচীন টেন্ডুলকারের সেঞ্চুরি তখন ১২টি। এই লেখা মূলত ১৯৯৯ বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে সাঈদ আনোয়ারের সেঞ্চুরি নিয়ে, তবে তাতেই সীমাবদ্ধ না থেকে এতে উঠে এসেছে সাঈদ আনোয়ারের আরও অনেক ব্যাটিং র্কীর্তি।

'বেস্ট' শব্দটির প্রতি ওয়াসিম আকরামের একটা দুর্বলতা আছে। যে কয়েক দফায় পাকিস্তানের অধিনায়কত্ব করেছেন, অন্তত সাংবাদিকরা তখন খুব ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছেন এটি। এজন্য এই বাঁহাতি অলরাউন্ডারের যেকোনো প্রেস কনফারেন্সে উপস্থিত থাকাটাই ছিল যথেষ্ট। তাঁর দলের যেকোনো খেলোয়াড়ের কথা উঠলেই ওয়াসিম আকরামের কথায় অনিবার্যভাবে চলে আসত এই শব্দটি। যেমন 'ওয়াকার ওয়ার্ল্ডের বেস্ট ফাস্ট বোলার', 'ইজাজ-ইনজামাম ফাস্ট বোলিংয়ের বিপক্ষে বেস্ট ব্যাটসম্যান', 'সাকলায়েন বেস্ট অফ স্পিনার', 'শহীদ আফ্রিদি বেস্ট ইয়াং প্লেয়ার' ইত্যাদি ইত্যাদি। এর সবগুলোই যে বাড়াবাড়ি, তা নয়। তবে সমস্যা হলো, ওয়াসিম আকরাম স্বীকৃতিটা দু-একজনের ক্ষেত্রে ব্যবহার না করে তা অকাতরে বিলিয়ে যেতেন। ফলে তাঁর ব্যবহৃত 'বেস্ট' শব্দটি অনেকটাই তাৎপর্য হারিয়ে হয়ে উঠত রসিকতার বিষয়। অনেক সময় তাঁর প্রেস কনফারেন্সে বসেই মুখ টিপে হাসতেন সাংবাদিকরা।

ওল্ড ট্রাফোর্ডে কেউ হাসলেন না। বরং সাঈদ আনোয়ারকে যখন ওয়াসিম আকরাম বিশ্বের 'বেস্ট ব্যাটসম্যান বলে ঘোষণা করছেন, সাংবাদিকদের অনেকের চোখেমুখেও দেখা গেল মৌন সমর্থন। একটু আগে যার ব্যাটিংয়ে বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল পরিণত হয়েছে নিতান্তই প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন ম্যাড়মেড়ে এক ম্যাচে, তাঁকে বিশ্বসেরা বলাটা অন্তত সেই মুহূর্তে মোটেই বাড়াবাড়ি শোনাচ্ছে না। তবে শুধু নিউজিল্যান্ডকে উড়িয়ে দেওয়া অপরাজিত সেঞ্চুরিটিই তো আর কারণ হতে পারে না, কারণ ছিল আরও। ওয়াসিম আকরাম যখন এ কথা বলছেন, ওভালে ঠিক আগের ম্যাচে জিম্বাবুয়েকে ধ্বংস করে দেওয়া সাঈদ আনোয়ারের সেঞ্চুরিটিও উঁকি দিচ্ছে সবার মনে। তা দিলেও বা কি! পর পর দুই ম্যাচে সেঞ্চুরিই তো আর কোনো ব্যাটসম্যানকে 'বেস্ট' বলে দাবি করার সুযোগ করে দেয় না। সেজন্য এর আগে আরও কিছু কীর্তি গড়ে রাখতে হয়। সাঈদ আনোয়ার সেসব গড়েই খেলতে গিয়েছিলেন তাঁর দ্বিতীয় বিশ্বকাপ। আরেকটি ব্যাপারও কাজ করছিল সবার মনে। ওয়াসিম আকরামের 'বেস্ট' ঘোষণার আগেই তাঁর পাশে বসে সাঈদ আনোয়ারের এক দফা প্রশস্তি গেয়ে ফেলেছেন কিউই অধিনায়ক স্টিভেন ফ্লেমিং। 'সাঈদ আনোয়ার ব্যর্থ হলেই শুধু পাকিস্তানের ওপর চেপে বসা যায়'– প্রশংসাটা অনেক বড়, তবে এটি পাকিস্তানের সব প্রতিপক্ষেরই মনের কথা। সাঈদ আনোয়ারকে তাড়াতাড়ি ফিরিয়ে দেওয়ার পরও কখনো কখনো বিপক্ষ দলকে হারতে হয়, তবে তা না পারলে হারতে হয় সবসময়ই।

নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সেই `বেস্ট` ইনিংসের পথে। ছবি: গেটি ইমেজেস

নিয়মকে প্রমাণ করার জন্যই যেন ব্যতিক্রম হয়েছে দু-একবার। নির্দিষ্ট করে বললে দুবার। সাঈদ আনোয়ারের ১৯ সেঞ্চুরির মাত্র দুটিই দলকে জেতাতে পারেনি। ঢাকার দর্শক দেখেছেন তাঁর একটি। ১৯৯৮-এর জানুয়ারিতে ইন্ডিপেন্ডেন্স কাপ ফাইনালে পাকিস্তান ইনিংসের ৪৬তম ওভার পর্যন্ত ব্যাট করে ১৪০ রান করার পর তবেই আউট হয়েছিলেন সাঈদ আনোয়ার। তারপরও সেই ম্যাচে হেরেছিল পাকিস্তান। তবে তা যে সত্যিই ব্যতিক্রম, তার প্রমাণ পাকিস্তানকে হারাতে ভারতকে গড়তে হয়েছিল বিশ্ব রেকর্ড।

ইন্ডিপেন্ডেন্স কাপের তৃতীয় ফাইনালের ওই সেঞ্চুরি ছিল ওয়ানডেতে সাঈদ আনোয়ারের পঞ্চদশ। তাঁর সেঞ্চুরির পর পাকিস্তানের পরাজয়ের ঘটনা সেটিই প্রথম। এর আগে তাঁর ১৪টি সেঞ্চুরির ১৩টিই জিতিয়েছে পাকিস্তানকে, বাকি ম্যাচটি হয়েছে ‘টাই'। ওয়ানডেতে তাঁর পরের ৪টি সেঞ্চুরির মধ্যেও মাত্র একটিই পরাজিত দলের পক্ষে, পরের বছর কেনিয়ায় আইসিসি নকআউট বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে তাঁর সেঞ্চুরির পরও হারতে হয়েছিল পাকিস্তানকে। তা দুর্ঘটনা তো ঘটেই!

ওয়ানডেতে টানা তিন সেঞ্চুরির হ্যাটট্রিকের কীর্তি আছে তাঁর, স্বদেশী জহির আব্বাস ছাড়া বাকি সব ব্যাটসম্যানের কাছে যা শুধুই স্বপ্ন। ১৯৯৩-য়ের অক্টোবর-নভেম্বরে শারজায় চার দিনের মধ্যে ওই তিন সেঞ্চুরি করে সাঈদ আনোয়ারের 'কিং অব ডেজার্ট' পরিণত হওয়ার শুধু গল্প শুনেছি, তা দেখা হয়নি। তবে পর পর তিন ম্যাচে সেঞ্চুরি হ্যাটট্রিক না হোক, সুযোগ হয়েছে এই বাঁহাতি ওপেনারের টানা তিনটি সেঞ্চুরি দেখার। তবে তা টানা তিন ম্যাচে তো নয়ই, পার্থক্য আছে আরেকটু। শারজার ওই তিন সেঞ্চুরি এসেছিল মাত্র চার দিনে আর এই তিনটি আসতে লেগেছে প্রায় দেড় বছর। '৯৮-এর জানুয়ারিতে ঢাকায় তাঁর ১৫ নম্বর সেঞ্চুরিটি পাওয়ার পর ষোড়শ সেঞ্চুরির জন্য তাঁকে পরের বছরের জুন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে–সাঈদ আনোয়ার নিশ্চয়ই এটি কল্পনাও করেননি। এটিও কল্পনা করেননি যে, একটি দিনের জন্যও ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ সেঞ্চুরির রেকর্ডটির পাশে নাম লেখা হবে না তাঁর।

করেননি কেউই, কারণ ঢাকায় সাঈদ আনোয়ারের ১৫ নম্বর সেঞ্চুরির পর ডেসমন্ড হেইন্সের ১৭ সেঞ্চুরির রেকর্ড কে ভাঙবেন, এটি কোনো তর্কের বিষয় ছিল না। ছিল শুধু অপেক্ষা, সাঈদ আনোয়ার কবে ছাড়িয়ে যান ওই ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ওপেনারকে। অথচ ওই সেঞ্চুরিটির পরই যেন সাঈদ আনোয়ারের হঠাৎ পথ হারিয়ে ফেলা। ভাবতে বিস্ময় লাগে হেইন্সকে ছাড়িয়ে যেতে, ১৫ থেকে ১৮-য়ে পৌছুতে ২১ মাস লেগে গেল তাঁর। ঢাকার সেঞ্চুরিটির পর প্রায় ১৭ মাস সাঈদ আনোয়ারের এই আনন্দের সঙ্গে পরিচয় নেই। বিচিত্র সব ইনজুরি আর অসুস্থতা মিলিয়ে মাঠেও ছিলেন না নিয়মিত। ঢাকার পর তাই সেঞ্চুরি পেতে পেতে বিশ্বকাপ। বিশ্বকাপে পর পর দুই ম্যাচে সেঞ্চুরি হেইন্সের পাশে এনে দাঁড় করিয়েছিল তাঁকে। অথচ সেখান থেকে হেইন্সকে টপকে যেতেও লাগিয়ে ফেললেন ১৫ মাস। আসল বিশ্বকাপের পর আইসিসি নকআউট বিশ্বকাপ, নাইরোবিতে পর পর দুটি সেঞ্চুরি করে হেইন্সকে টপকে যাওয়ার পর সাঈদ আনোয়ার জানালেন, তিনি টেন্ডুলকারকে তাড়া করছেন না। করবেন কীভাবে? টেন্ডুলকার তো তত দিনে সবার ধরাছোঁয়ার বাইরে। অথচ একটা সময় টেন্ডুলকারেরই সাঈদ আনোয়ারকে তাড়া করার কথা ছিল। ঢাকায় আনোয়ার যখন পঞ্চদশ সেঞ্চুরিটি পেলেন, টেন্ডুলকারের ওয়ানডে সেঞ্চুরির সংখ্যা তখন ১২।

শুধু সেঞ্চুরি সংখ্যার বিচারেই নয়, ঢাকা আসার মাস ছয়েক আগে মাদ্রাজের এক বিকেলও তখন বাকি সবার কাছ থেকে আলাদা করে দিয়েছে সাঈদ আনোয়ারকে। সেটি ভারতের ইন্ডিপেন্ডেন্স কাপের ম্যাচ, সে ম্যাচে ভারতীয় বোলাররা তো ছিলই, লড়তে হয়েছে মাদ্রাজের বিখ্যাত আর্দ্রতা ও গরমের সঙ্গেও। সবাইকে হারিয়ে ভিভ রিচার্ডসের ১৮৯ রানের রেকর্ড ভেঙে দিয়ে পাকিস্তানি ওপেনার করেছেন ১৯৪। বিশ্বের সেরা ওয়ানডে ব্যাটসম্যান হিসেবে তাঁর নামই যে তখন বেশি উচ্চারিত হচ্ছে, তাতে তাই অবাক হওয়ার কিছু ছিল না।

১৯৪ রানের পথে তখন মাত্রই যাত্রা শুরু। ২০১০ সালের আগ পর্যন্ত যা ওয়ানডের সর্বোচ্চ স্কোর হয়ে ছিল। মাদ্রাজ, ১৯৯৭। ছবি: ইউটিউব

অথচ এর পরই ছন্দপতন। দৃশ্যপট থেকেই উধাও হয়ে গেলেন অনেক দিনের জন্য। কখনো ইনজুরি, কখনো বা অসুস্থতা মিলিয়ে অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছিল যে,  একবার খেলা ছেড়ে দেওয়ার কথা পর্যন্তও ভেবেছিলেন। এগুলো অবশ্য সাঈদ আনোয়ারের ক্যারিয়ারজুড়েই সঙ্গী বলা যায়। খেলোয়াড়দের ইনজুরি হতেই পারে, হয়ও, কিন্তু ইনজুরির পাশাপাশি এত বিচিত্র ধরনের অসুস্থতায় ভুগে তাঁর মতো খুব কম ক্রিকেটারকেই মাঠের বাইরে থাকতে হয়েছে। সাঈদ আনোয়ারের জন্য ১৯৯৯-এর বিশ্বকাপও ছিল আরেকটি 'কামব্যাক টুর্নামেন্ট', ইনজুরি-অসুস্থতা থেকে আবার মাঠে ফিরে আসা। অনেকদিন যে তিনি খেলায় নেই, সেটি যাতে কারও বুঝতে অসুবিধা না হয়. টুর্নামেন্টের শুরুতে খেলে গেলেন সেরকমই। ভারতের বিপক্ষে সুপার সিক্সের দ্বিতীয় ম্যাচটির আগে খেলা ছয় ম্যাচে ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ স্কোরের মালিককে দেখে মায়া হলো অনেকের। তা মায়া হওয়ারই কথা, ছয় ম্যাচে ১০১ রান করা সাঈদ আনোয়ারকে তখন দেখাচ্ছে রাজ্যপাটহীন রাজার মতো। এ রকম অবস্থায় ভারতের সঙ্গে ম্যাচ, স্বরূপে ফেরার ইঙ্গিত সে ম্যাচেই। খারাপ সময়ে ভাগ্যের একটু পক্ষপাত প্রয়োজন হয়, তা পেলে এদিনই হয়তো বড় কিছু করে ফেলেন সাঈদ আনোয়ার। ভারতীয় বোলারদের চোখেমুখে ‘মাদ্রাজের দুঃস্বপ্ন' ফুটিয়ে তুলে ৪৩ বলে ৩৬ রান করার পর প্রথম ভুল, সেই ভুলেই পরিণত হলেন স্লিপে আজহারের দারুণ এক ক্যাচে।

জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে পরের ম্যাচে পার্থক্যটা রচিত হলো এখানেই। সপ্তম ওভারে সেই স্লিপেই ক্যাচ ফেললেন অ্যালিস্টার ক্যাম্পবেল, প্রয়োজন ছিল এটুকুই, এরপর আর পেছন ফিরে তাকালেন না সাঈদ আনোয়ার। পাকিস্তান সুপার সিক্সের শেষ সে ম্যাচটি খেলছিল ওভালে; তিন বছর আগে এই মাঠেই ইংল্যান্ড বোলারদের চোখের জল-নাকের জল এক করে সাঈদ আনোয়ার খেলেছিলেন ১৭৬ রানের এক ক্ল্যাসিক টেস্ট ইনিংস। ইংল্যান্ডে কিছু না করলে নাক উঁচু ব্রিটিশ সাংবাদিকদের কলমে প্রশংসা পাওয়া কঠিন, সেই ইনিংস তাঁর এ সমস্যা ঘুচিয়েছিল। ইংল্যান্ডেরই কোন কাগজে যেন পড়েছিলাম এই প্রশস্তি–বল অফ স্টাম্পের যত বাইরেই থাকুক, সাঈদ আনোয়ারের হাত ইলাস্টিকের মতো বাড়তে বাড়তে ঠিকই নাগাল পেয়েছে তাঁর হাত।

জিম্বাবুইয়ান বোলারদের এতটা দুঃস্বপ্নের মুখোমুখি হতে হয়নি। ফর্ম ফিরে পাওয়ার এমন সুযোগ হেলায় হারানো ঠিক হবে না ভেবে সাঈদ আনোয়ার একটু দেখে-শুনেই খেললেন। এ কারণেই যে বাউন্ডারিটি তাঁকে ষোড়শ সেঞ্চুরিতে পৌঁছে দিল, দেখা গেল সেটি তাঁর ইনিংসের মাত্র ১১ নম্বর বাউন্ডারি। সাঈদ আনোয়ারের ব্যাটিংয়ের সঙ্গে যাঁর সামান্যতম পরিচয়ও আছে, তিনিও বুঝবেন, সেঞ্চুরিতে ১১টি বাউন্ডারি তাঁর জন্য নিতান্তই কম। স্ট্রোক প্লের বিচারে অন্য অনেক ইনিংসের চেয়ে এটি পিছিয়ে, বিপক্ষ বোলিংও এমন প্রথম সারির কিছু নয়, তাঁরপরও সাঈদ আনোয়ারের যোল সেঞ্চুরির মধ্যে এটির একটু আলাদা মহিমা ছিল। দুই বিশ্বকাপ মিলিয়ে ১৪তম ম্যাচে এসে তাঁর কাছে ধরা দিল প্রথম সেঞ্চুরি। অস্ট্রেলিয়ায় সাফল্যের রেকর্ড থাকার পরও ইমরান খানের ১৯৯২ বিশ্বকাপজয়ী দলে কেন যেন জায়গা পাননি, যদিও ইমরানই তাঁকে দিয়েছিলেন প্রথম সুযোগ, মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান থেকে বানিয়েছিলেন ওপেনার। বিশ্বকাপে অভিষেকের জন্য তাই অপেক্ষা করতে হলো ১৯৯৬ পর্যন্ত, সেবার কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে পাকিস্তানের বিদায়ের আগ পর্যন্ত প্রতিটি ম্যাচেই দলকে দিয়েছেন দারুণ সূচনা, কিন্তু ৮২ গড়ে ৩২৯ রান করলেও সেঞ্চুরি পাওয়া হয়নি। শেষ পর্যন্ত সেই সেঞ্চুরি যখন এল, তা সঙ্গে নিয়ে এল উদযাপনের আরেকটি উপলক্ষ। জিম্বাবুয়ে বোলারদের কাঁদাতে কাঁদাতে ওয়ানডের সিক্স থাউজ্যান্ড ক্লাবেও ঢুকে গেলেন সাঈদ আনোয়ার।

জিম্বাবুয়ের সঙ্গে সেঞ্চুরির পথে, যে সেঞ্চুরি ছিল ফর্মে ফেরার জ্বালানি। ছবি: গেটি ইমেজেস

সাঈদ আনোয়ারের ফর্মে ফেরা যেকোনো দলের জন্যই বড় দুঃসংবাদ। তার পরও ওল্ড ট্রাফোর্ডে সেমিফাইনালের আগে কিউই বোলাররা আচ্ছন্ন হয়ে রইলেন অন্য একজনকে নিয়ে। ১৯৯২ বিশ্বকাপ সেমিফাইনালের স্মৃতি সেমিফাইনালের আগের দিন ইনজামামময় করে রাখল পুরো ওল্ড ট্রাফোর্ডকে। সংবাদ সম্মেলনে এ নিয়ে এত প্রশ্ন হতে লাগল যে, এক পর্যায়ে কিউই অধিনায়ক স্টিভেন ফ্লেমিংকে পর্যন্ত মনে করিয়ে দিতে হলো, ‘ভাই রে, পাকিস্তান দলে আরও ব্যাটসম্যান আছে'।

সবাইকে শুধু ইনজামাম-ইনজামাম করতে দেখে সাঈদ আনোয়ারও হয়তো মনে মনে একটা প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। তবে সে প্রতিজ্ঞা আর যা-ই হোক, পরদিন সেমিফাইনালে ইনজামামকে ব্যাট করারই সুযোগ দেবেন না–এতটা উচ্চাভিলাষী হওয়ার কথা নয়। অথচ পরদিন হলো তা-ই। পাকিস্তানের অধিকাংশ তরুণ ব্যাটসম্যানের মতো ওয়াজাহতুল্লাহ ওয়াস্তির চোখেও বর্তমান ক্রিকেটে 'সাঈদ ভাইয়ের চেয়ে ভালো ব্যাটসম্যান নেই’। সেই ওয়াস্তি ইনিংস শুরু করার সময় সাঈদ ভাইয়ের মুখ থেকে যখন শুনলেন, 'আজ আর আমরা কাউকে নামতে দেব না’, হঠাৎ করেই তাঁর মন থেকে বিশ্বকাপ সেমিফাইনালের চাপ-টাপ সব উধাও। 'সাঈদ ভাই'য়ের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া কঠিন, তারপরও তাঁর ব্যাট থেকেও বেরিয়ে আসতে লাগল দুর্দান্ত সব শট। আর সাঈদ আনোয়ার যেন নেমেছেন মাঝের ফর্মহীন সময়টার ক্ষতি পূরণ করতেই। বোলারদের দুঃস্বপ্ন হয়ে এমন দিন মাঝেমধ্যেই আসে, তৃতীয় ওভারেই বোঝা গেল এটি সাঈদ আনোয়ারের সে রকমই আরেকটি দিন– যেদিন বোলার কারা, বোলিং কেমন এসবে কিছুই আসে যায় না। তখন পর্যন্ত সেই বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি উইকেট নিয়ে অপ্রত্যাশিত 'হিরো' বনে গেছেন যে জিওফ অ্যালট, তৃতীয় ওভারে সেই বাঁহাতি ফাস্ট বোলারের দুটি ইয়র্কারের চেষ্টা সাঈদ আনোয়ারের কল্যাণে কাভারে চমৎকার শটে পরিণত হওয়ার পর টিভির পর্দায় ফুটে ওঠা ক্লোজআপ দেখাল অধিনায়ক স্টিভেন ফ্লেমিংয়ের মহাচিন্তিত মুখ। বাকি ম্যাচে একবারের জন্যও আর হাসি ফুটল না সে মুখে।

এমনই দারুণ সব শটে সাজানো ছিল সাঈদ আনোয়ারের সেদিনের ইনিংস। ছবি: গেটি ইমেজেস

ব্যাটসম্যান একের পর এক স্ট্রোক খেলতে থাকলে তাৎক্ষণিক হতাশার মধ্যেও একটা আশার আলো দেখতে পান বোলাররা। একবার তো ভুল হবেই– এই আশ্বাসটুকু অন্তত থাকে তাতে। কিউই বোলারদের সেদিন সেই খড়কুটোটুকু আঁকড়ে ধরার সুযোগও দিলেন না সাঈদ আনোয়ার। বোলিং খুন করার কোনো অভিপ্রায় নয়, সেদিন তিনি নেমেছেন বোলারদের তিলে তিলে হতাশায় ডুবিয়ে দেওয়ার প্রতিজ্ঞা নিয়ে। তারপরও স্কোরবোর্ড এগোচ্ছিল তরতর করেই। ৯ ওভারেই তাতে উঠে গেল ৫০। তা ওয়ানডেতে এমন তো কতই হয়, এটি ফ্লেমিংয়ের মূল দুশ্চিন্তা ছিল না। দুই ব্যাটসম্যান, বিশেষ করে সাঈদ আনোয়ারকে যে তাঁর বোলাররা মুহূর্তের জন্যও বিব্রত করতে পারছে না, তাঁর কপালে ভাঁজের সংখ্যা বাড়িয়ে তোলায় এটিরই ছিল সবচেয়ে বড় ভূমিকা।

ইনিংসের মাঝামাঝি সামান্য ব্যবধানে ফিফটিতে পৌঁছুলেন দুই ওপেনারই। ওয়াস্তিই প্রথম, তবে সাঈদ আনোয়ারের লাগল ১২ বল কম। ৭২ বলে ফিফটি, চার মাত্র ৪টি– সাঈদ আনোয়ার যেন নেমেছেন ফাইনালের জন্য ব্যাটিং প্র্যাকটিস করতে। ম্যানচেস্টারে এমনিতেই প্রচুর পাকিস্তানির বাস, প্রায় এক যুগ ল্যাংকাশায়ারে খেলার কারণে ওল্ড ট্রাফোর্ডকে ওয়াসিম আকরামও বলেন তাঁর 'হোম গ্রাউন্ড', পাকিস্তানি পতাকায় সয়লাব গ্যালারি দেখে সেদিন ওল্ড ট্রাফোর্ডকে লাহোর মনে হওয়ার কারণ ছিল যথেষ্টই। সেই দর্শকদের চিৎকার আর তাদের হাতের বাদ্যযন্ত্রকে তার স্বরে তুলে সেঞ্চুরি পার্টনারশিপ হয়ে গেল ওপেনিংয়ে। দেখতে দেখতে তা ১৫০। ৩৮তম ওভারে এসে আবারও একটি উদযাপনের উপলক্ষ খুঁজে পেল দর্শকরা। ১৯৯৬ বিশ্বকাপে হল্যান্ডের বিপক্ষে দক্ষিণ আফ্রিকার গ্যারি কারস্টেন আর অ্যান্ড্রু হাডসনের ১৮৬ টপকে বিশ্বকাপে ওপেনিং পার্টনারশিপের নতুন রেকর্ড করে ফেলেছেন আনোয়ার-ওয়াস্তি।

সেঞ্চুরির পর, যে সেঞ্চুরিতে বসেছিলেন ডেসমন্ড হেইন্সের পাশে। ছবি: গেটি ইমেজেস

এর আগে আরও তিনবার বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে উঠেও ফাইনাল খেলা হয়নি নিউজিল্যান্ডের। চতুর্থবারে এসে ব্যতিক্রম ঘটানোর যে স্বপ্ন দেখেছিল ছোট্ট দেশটি, ততক্ষণে তা ভেঙে খানখান। স্বপ্নের এমন করুণ মৃত্যু বিশ্বকাপ খুব বেশি দেখেনি। সেমিফাইনালের মতো একটি ম্যাচ কোনো দলের এমন অসহায় আত্মসমর্পণের সাক্ষী হতে পারে, এটিও না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। কদিন পর অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ফাইনালে পাকিস্তানও একই রকম অবিশ্বাস জাগিয়েছে, সেটি ভিন্ন প্রসঙ্গ।

নোট-টোট নেওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল আগেই, প্রেসবক্সে বেশির ভাগ সাংবাদিকই ম্যাচ রিপোর্ট লিখতে শুরু করে দিয়েছেন, এমন সময় ওয়াস্তির প্রথম ভুল। পাকিস্তান ইনিংসের ৪১তম ওভারে রেকর্ড পার্টনারশিপটি ১৯৪ রানে যখন শেষ হলো, সাঈদ আনোয়ার সেঞ্চুরি থেকে মাত্র ৪ রান দূরে দাঁড়িয়ে। তা পেতে সময় লাগল না। ১৩৭ বলে সেঞ্চুরি অর্থাৎ দ্বিতীয় ফিফটি ৬৫ বলে, বাউন্ডারি এবারও ৪টিই। ব্যাট তোলার সময় ডেসমন্ড হেইন্সকে নিশ্চয়ই মনে পড়েছে তাঁর, এটি সাঈদ আনোয়ারের ১৭ নম্বর সেঞ্চুরি, ক্যারিবীয় ওপেনারও ১৭টি সেঞ্চুরি করে অনেকদিনই ভোগ করেছেন ওয়ানডে সেঞ্চুরিয়ানদের তালিকার শীর্ষস্থানটি। তবে তত দিনে সাঈদ আনোয়ারের সে জায়গায় যাওয়ার স্বপ্ন শেষ, শচীন টেন্ডুলকার সে বিশ্বকাপেই করে ফেলেছেন ওয়ানডেতে তাঁর ২২ নম্বর সেঞ্চুরি।

জয়সূচক শট। ছবি: গেটি ইমেজেস

প্রিয় দল ফাইনালে উঠে যাচ্ছে– এই আনন্দই বাঁধ মানছিল না, সাঈদ আনোয়ারের সেঞ্চুরির পর গ্যালারিতে বসে বসে এই আনন্দ উদযাপন করাটা কিছু পাকিস্তানি সমর্থকের কাছে খুবই অকিঞ্চিৎকর বলে মনে হলো। বেশ কয়েকজন তাই নেমে এলেন মাঠে, সাঈদ আনোয়ার পর্যন্তও পৌঁছে গেলেন তাদের কেউ কেউ। পুলিশও ছুটল তাদের পিছু পিছু, নিরুত্তাপ সে ম্যাচে মাঠে পুলিশ-দর্শক বউচি খেলাই যা একটু আনন্দের বাহন হয়ে এল। কিছুক্ষণ পর অবশ্য অন্তত খেলোয়াড়দের জন্য এটি আর আনন্দের না থেকে হয়ে দাঁড়াল আতঙ্কের ব্যাপার। নির্ভার হয়ে ব্যাট চালানোর সুযোগ পাওয়ায় নেমেই ঝড় তুলেছিলেন ইজাজ আহমেদ। তাতে অনেকটাই আড়ালে চলে যাওয়া সাঈদ আনোয়ার শেষটা তাঁর হাতেই হওয়া উচিত ভেবে নাথান অ্যাস্টলকে স্ট্রেট ড্রাইভ করে বাউন্ডারিটি মেরে পাকিস্তানকে নিয়ে গেলেন নিউজিল্যান্ডের স্কোরের ঠিক ১ রান পেছনে। পরের বলটি লং অফের দিকে তুলে মেরেছেন কী মারেননি, মাঠে ধেয়ে এল রীতিমতো জনস্রোত। নিউজিল্যান্ড ফিল্ডাররা বল কোথায়– এই খোঁজ বাদ দিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটলেন ড্রেসিংরুমের দিকে, সাঈদ আনোয়ার ও ইজাজ আহমেদও তা-ই। বল। বাউন্ডারিতে যাওয়ার আগেই তা চলে গেছে কোনো এক দর্শকের অধিকারে, সাঈদ আনোয়ারও বল মেরে অন্য প্রান্তে যাওয়ার আগেই দিয়েছেন প্রাণপণ দৌড়, তারপরও ম্যাচ ওখানেই শেষ । ম্যাচ রেফারির সিদ্ধান্তে ২ রান দেওয়া হলো পাকিস্তানকে। হতে পারত ১১৫, পরিবর্তে অপরাজিত ১১৩ রান নিয়েই খুশি থাকতে হলো সাঈদ আনোয়ারকে। খুশি তিনি তখন আরেকটি কারণেও। ক্যারিয়ারে প্রথম বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলার রোমাঞ্চের সঙ্গে যোগ হয়েছে আরেকবার সেঞ্চুরির হ্যাটট্রিকের সম্ভাবনা।

ফাইনালে সেই সম্ভাবনার করুণ মৃত্যুতেই বলতে গেলে নিশ্চিত হয়ে গেছে আরেকটি স্বপ্নেরও সমাধি। সেই স্বপ্নটি ওয়াসিম আকরামের, বিশ্বকাপ হাতে নিজের ছবিটি তাঁর বাড়ির দেয়ালে অনেকদিন নিঃসঙ্গ ঝুলে থাকা 'গুরু' ইমরান খানের পাশে টানিয়ে রাখার স্বপ্ন!

(লেখকের 'সেই সব ইনিংস' বই থেকে)

আরও পড়ুন......
ক্রিকেট, জীবন–সবই অন্য চোখে দেখছেন সাঈদ আনোয়ার
একসঙ্গে সাঈদ আনোয়ার-আমির সোহেল
সাঈদ আনোয়ার-আমির সোহেল: ইন্টারভিউয়ে যা লেখা হয়নি
রশিদ লতিফের জবানিতে ব্যাটসম্যান ও মানুষ সাঈদ আনোয়ার
 

 

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×